নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে বিধান আমাদের দেশে ১৯৯৬ সাল থেকে চলে আসছে, তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। অনেকে এটাকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিনব তান্ত্রিক অবদান বলে গর্ববোধ করতেন। আমি ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময় বলে এসেছি যে, সংবিধানের এইরূপ বিধান গণতন্ত্রের জন্য সবলতা নয়, বরং দুর্বলতারই পরিচায়ক।
নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য যেটা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা হলো অর্থ ও অস্ত্রের দাপট এবং সাম্প্রদায়িক প্রচার বন্ধ করা। এ পর্যন্ত সকল নির্বাচনেই আইন কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণের অতিরিক্ত অর্থের ব্যবহার, টাকা দিয়ে ভোট কেনা ও প্রভাবিত করার কাজটি চলে আসছে।
১৯৯০ সালে সামরিক শাসনের অবসানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমরা একটি বিশেষ ব্যবস্থা হিসাবে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীনে এক ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সামরিক শাসনকালে নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা উঠে গিয়েছিল। তাই সেদিন আমরা বামপন্থীরা বলেছিলাম যে, নির্বাচনে আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনে অন্তত: কয়েক টার্ম নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা থাকুক। কিন্তু সেদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউই রাজী হয়নি।
১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উত্থাপন করে আওয়ামী লীগ এবং আন্দোলন গড়ে তোলে। তারপর বিএনপি বাধ্য হয় এই দাবি মেনে নিতে। ১৯৯৬ সালে ও ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন–এই নিয়ে যে বিরোধ এবং তা থেকে যে সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব এবং সবশেষে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বৎসর ধরে অবৈধভাবে শাসন ইত্যাদি ঘটনা আমাদের জানা আছে। তখনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দুর্বলতা ধরা পড়তে থাকে এবং বহুজন বহু বিজ্ঞ ব্যক্তিও বহু ধরনের সংস্কারের পথ নির্দেশ করেন। এদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকেই চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে যে মামলা হয়েছিল তার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটিই বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বর্তমান সরকার।
বর্তমান সরকার হাইকোর্টের বরাত দিয়ে এই বিধান বাতিল করার সুযোগ পেলেও তারা কিন্তু হাইকোর্টের পুরো পরামর্শ গ্রহণ করেন নি। বিজ্ঞ হাইকোর্ট সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আরও দুই টার্ম অর্থাৎ পরবর্তী আরও দুটি সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। রায়ের এই অংশটি এসেছে পরামর্শরূপে, বাধ্যতামূলক নয়। পরামর্শ সংসদের কাছে। সংবিধানকে সংশোধন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে যে বর্তমান সরকারের তারা এই সুযোগটি গ্রহণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি এখন থেকেই পুরোপুরি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আমার বিবেচনায় কাজটি তারা ভালো করেননি। বিজ্ঞোচিত হয়নি। এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, নির্বাচনের প্রতি অনাস্থা ও নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি এক এগারোর আশঙ্কাও থেকে যায়।
আমরা লক্ষ্ করছি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই ক্ষমতায় থাকলে এক রকম ও ক্ষমতার বাইরে থাকলে আরেক রকম আচরণ করে আসছে। ক্ষমতা থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে এবং বাইরে থাকলে পক্ষে। নির্বাচনে যে দল যখনই পরাজিত হয় তখনই তারা সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির অভিযোগ আনে। আর বিরোধী দলের লাগাতার সংসদ বর্জন, এমনকি পদত্যাগ বা পদত্যাগের হুমকি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলি সচেতনভাবে এই অশুভ প্রবণতা পরিত্যাগ না করলে তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ হবে না। তেমনি এখনই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান উঠিয়ে দেয়া, হাইকোর্টের পরামর্শকে আংশিকভাবে গ্রহণ করা তাদের নিজেদের জন্য এবং সারা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না। বরং অশনি সংকেত শোনা যাচ্ছে।
হায়দার আকবর খান রনো : কমিউনিস্ট নেতা ও প্রাবন্ধিক।