বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শ্রমিক বলতে প্রধানতঃ গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক। পাকিস্তান আমল থেকে এই দেশে যে ট্র্যাডিশনাল শিল্প ছিল, যেমন পাটকল, বস্ত্রকল ও চিনিকল তা প্রায় বিলুপ্ত হবার পথে। আদমজীসহ বড় বড় জুট এখন একেবারে বিলুপ্ত অথবা বন্ধ রয়েছে। টঙ্গী অথবা শীতলক্ষা পারে যে সুতা ও কাপড়ের কারখানা ছিল, সেগুলি এখন জনশূন, নিষ্প্রাণ। বিশ্বায়নের প্রভাবে এক ধরনের বিশিল্পায়ন ঘটেছে নব্বই এর দশক থেকে। তবে শ্রমিক সংখ্যা হ্রাস পায়নি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি-শ্রমিক বাদ দিলেও প্রাতিষ্ঠানিক ও ইনফরমাল প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমিকের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও তা যে এক কোটির উপরে হবে এটা বলা চলে।
বাংলাদেশের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে এক ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে গত দেড়-দুই দশকে। বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে পড়লেও, ছোট ও মাঝারী শিল্প তৈরী হয়েছে অনেক। এই সকল শিল্পের মালিকরাও নতুন, শ্রমিকও নতুন প্রজন্মের। তার মধ্যে নারী শ্রমিকের প্রাধান্য বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। সবচেয়ে বড় শিল্পখাত হলো গার্মেন্টস শিল্প। প্রধানতঃ ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুইটি বড় শহরে ও তার আশেপাশে রেডিমেড গার্মেন্টসের কারখানাগুলো অবস্থিত রয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত আছে প্রায় তিরিশ লক্ষ শ্রমিক, যার ৮০ শতাংশ নারী, যাদের গড় বয়স ১৭ বৎসর মাত্র। আগের জুট মিল বা টেকসটাইল মিলকে ঘিরে থাকতো শ্রমিক কলোনী। ঢাকার আদমজী, ডেমরা, শীতলক্ষার পার অথবা টঙ্গীতে ছিল শ্রমিক কনোলী। হাজার হাজার শ্রমিক একসঙ্গে বাস করতো, যা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের জন্য বড় শক্তি। এখন আর সে রকম শ্রমিক কলোনী নাই। তবে ঢাকার আশেপাশে কয়েকটি অঞ্চলে গড়ে উঠেছে গার্মেন্টস পল্লী বা শ্রমিক-বস্তি, যেখানে নানা কারখানার শ্রমিক একত্রে গাদাগাদি করে বাস করে।
এই শ্রমিকদের পাঁচ শতাংশও সংগঠিত নয়। অন্যদিকে, মালিকরাও আধুনিক বুর্জোয়া হয়ে উঠতে পারেনি। তাদের মধ্যে সামন্ত মানসিকতা কাজ করে। তারা কোনভাবেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন মেনে নিতে রাজী নয়। তারা প্রধানতঃ আদিম কায়দায় শোষণ করতে অভ্যস্ত ও স্বভাবগতভাবে লুটেরা চরিত্রের। ফলে গার্মেন্টস শিল্পে শোষণের হারও বেশী, কারখানার পরিবেশও অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর। ফলে স্বাভাবিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বিকশিত না হয়ে বার বার স্বতঃস্ফর্ত অভূত্থান ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক অঙ্গন যে আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, তা কোন অস্বাভাবিক ও নতুন ঘটনা নয়।
গার্মেন্টস শিল্পে নূন্যতম মাসিক পাঁচ হাজার টাকা মজুরীর দাবী উঠেছে। এ ব্যাপারে শ্রমিকদের মধ্যে সাধারণ ঐক্যমত্য লক্ষ্য করা গেছে। জাতীয় পর্যায়ে যে সকল শ্রমিক সংগঠন আছে, তারা সকলেই এই দাবীর প্রশ্নেও একমত হয়েছেন। আজকের বাজার দর হিসেব করলে এই দাবী খুবই ন্যায়সঙ্গত। আইএলও কনভেশনে উেল্লখ আছে, একজন শ্রমিকের নূন্যতম কতটা পুষ্টি দরকার। এমনকি সাবান ইত্যাদিও কতটা দরকার। তাও উেল্লখিত আছে। সেই সব হিসেব করলে শ্রমিকের মজুরী আরও বেশী হওয়া উচিত। এখানে আরও উেল্রখ্য যে, ট্রাডিশনাল পাট ও বস্ত্র শিল্পে শ্রমিকদের জন্য থাকার কলোনী, চিকিৎসা ভাতা ইত্যাদি ফ্রিজ বেনিফিটের ব্যবস্থা ছিল যা পাকিস্তান আমলে শ্রমিকরা অনেক সংগ্রাম করে আদায় করেছিল তা আজকের গার্মেন্টস শিল্পে অথবা নতুন গজিয়ে ওঠা কারখানাসমূহে অনুপস্থিত রয়েছে। তাই সব মিলিয়ে, শ্রমিকের ঘর ভাড়া, ওষুধ ও চিকিৎসা খরচ, নূন্যপক্ষে চারজনের এক পরিবারের জন্য মাসিক পাঁচ হাজার টাকা মোটেই বেশি নয়।
মালিকরা পাল্টা হুমকি দিচ্ছে যে, নূন্যতম মজুরী এত বেশী হলে তারা নাকি কারখানা বন্ধ করে দেবে। এটা আসলে ফাকা হুমকি। কারণ হিসেব করে দেখা গেছে যে, পাঁচ হাজার টাকা নূন্যতম মঞ্জুরী এবং সেই অনুপাতে অন্যান্য স্কেলের মঞ্জুরী ও পিস রেটের দাম নির্ধারণ করলেও মালিকের মোটা মুনাফা থাকবে। ২০০৬ সালের জুন মাসে এক বিরাট শ্রমিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন প্রথমবারের মতো সরকারের টনক নড়েছিল। তারা গার্মেন্টস শিল্পে নূন্যতম মঞ্জুরী নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি নিয়োগ করেছিল যেখানে সকলেই ছিল মালিকের প্রতিনিধি অথবা মালিক পক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল। নাজমা নামে একজন শ্রমিক নেত্রী ছিলেন, কিন্তু তিনি সরকার কর্তৃক মনোনীত ছিলেন। সেই কমিটি নূন্যতম মঞ্জুরী নির্ধারণ করেছিল মাসিক মাত্র ১৬৬২ টাকা ৫০ পয়সা। সেদিন কোন শ্রমিক সংগঠন এটা মানেনি। তথন দাবী ছিল তিন হাজার টাকার নূন্যতম মঞ্জুরীর। পাঁচ বৎসর পর মুদ্রাস্ফীতি হিসেব করলে এখন পাঁচ হাজার টাকা খুবই যুক্তিসক্ষত।
এরপর আসা যাক শ্রম দিবস প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে শ্রম আইনে এ সম্পর্কে সুসঙ্গত বিধান আছে। তা হলো (১) সপ্তাহে ছয়দিন শ্রমিকরা কাজ করবেন, প্রতিদিন আট ঘন্টার বেশী নয় (২) দুই ঘন্টা ওভার টাইম কাজ করানো যেতে পারে, কিন্তু কোনক্রমেই তার বেশী নয়। অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই ১০ ঘন্টার অতিরিক্ত হতে পারবে না। (৩) এই অতিরিক্ত দুই ঘন্টার জন্য শ্রমিককে দ্বিগুন মজুরী দিতে হবে। (৪) কোন অবস্থাতেই মিল কর্তৃপক্ষ জোর করে অর্থাৎ শ্রমিকের সম্মতি বতিরেকে ওভারটাইম কাজ করাতে পারবে না।
এটা জোরের সঙ্গে বলা যায় যে, ব্যতিক্রমহীনভাবে কোন গার্মেন্টস কারখানায়, এই আইন মানা হয় না। শ্রমিককে জোর করে ১৬/১৮ ঘন্টা এমনকি তার চেয়ে বেশী পরিশ্রম করতে বাধ্য করা হয়। আর দ্বিগুন মজুরীও দেয়া হয় না। বস্তুত: কারখানায় এক ধরণের শ্রম দাসত্ব চলছে। এছাড়াও কারখানার পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর। ব্যবস্থাপনাও অমানবিক। অধিকাংশ কারখানায় মহিলা শ্রমিকদের পর্যন্ত বাথরুমে যাবার জন্য পাঁচ মিনিট ছুটি দিতেও চায় না কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া দৈহিক নির্যাতন, গালিগালাজ ও এমনকি যৌন নিপাড়নের ঘটনাও আছে। বস্তুত: নব্য ধনীক যারা কারখানার মালিক হয়েছে, তাদের সাংস্কৃতিক মানও সাধারণভাবে বেশ নিচু।
গার্মেন্টস কারখানায় আগুন লাগার ঘটনাও অনেক। গত এক দশকে প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক আগুনের কারণে মারা গেছেন। কারখানায় বৈদ্যুতিক সর্ট সার্কিটের কারণে আগুন লাগে। এটি দুর্ঘটনা। অবশ্য এক্ষেত্রও মালিকের অসাবধনতাও দায়ী। কিন্তু তার চেয়ে বড় অপরাধ তারা যেটা করে তা হলো, তারা বের হবার প্রধান গেট বন্ধ রাখে। তার উপর অপ্রসস্থ সিড়ি ও করিডোর হওয়ার ফলে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়েও মারা গেছেন অনেক শ্রমিক। এই সকল অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। তাছাড়া শ্রম আইন লঙ্ঘন করার জন্য যে শাস্তির বিধান আছে, সেই শাস্তি এখনও পর্যন্ত কোন মালিক পায়নি। দুই একটি মালিক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেলে তারা হয়তো কিছুটা সচেতন হতো।
আগেই বলেছি এই মালিকরা নব্যধনীক এবং মূলতঃ লুটেরা চরিত্রের (তাই তারা কিছুতেই ট্রেড ইউনিয়ন মেনে নিতে রাজী নয়) ফলে গার্মেন্টস কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করা খুবই কঠিন। শ্রকিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করার উদ্যোগ নিলে উদ্যোক্তাদের ছাটাই করবে।মিথ্যা মামলা দেবে এবং রাস্তায় ভাড়াটিয়া গুন্ডাদের দিয়ে আক্রমন করবে। সম্প্রতি সরকার শ্রম আইন সংশোধন করে ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনের জন্য যে বিধান করেছে তাতে আরও কঠিন হয়েছে ট্রেড ইউনিয়ন করা। এখনকার বিধান অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন পেতে হলে সরকারের শ্রম দফতর প্রথমে ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তা ও সদস্যদের নাম মালিকের কাছে পাঠাবে এবং মালিকের সম্মতি নিতে হবে। অর্থাৎ ট্রেড ইউনিয়নকে মালিকের অধীনস্থ করার প্রয়াস। এতেই প্রমাণিত হয় সরকার কার স্বার্থে কাজ করছে। বস্তুত: এ যাবৎকালের সকল সরকার এবং প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি যে ধনীক শ্রেণীর প্রতিনিধি ও শ্রমিক বিদ্বেষী তার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে।
কিন্তু শোষণ নিপীড়ন যেখানে আছে সেখানে প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই। এটা প্রকৃতির নিয়ম। তাই শ্রমিক আন্দোলন স্বাভাবিক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের পথ না পেয়ে রাজপথ অবরোধ ও অভ্যূত্থানের পথ বেছে নিচ্ছে। মালিক ও সরকার বলার চেষ্টা করে যে এখানে নাকি কোন তৃতীয় পক্ষের উস্কানীতে ভাঙ্গচোর ইত্যাদি হচ্ছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও এমন অভিযোগ করেছেন। বিদেশী এজেন্টের কারসাজি–এই অভিযোগে তদানিন্তন কেয়ারটেকার সরকারের আমলে একজনকে গ্রেপ্তারও করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের হস্তক্ষেপের কারণে ২৪ ঘন্টার মধ্যে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
কয়েকমাস আগে হামিমগ্রুপের একটি কারখানায় আগুন লাগিয়েছিল কতিপয় দুস্ষ্কৃতিকারী । জানা গেছে তারা জুট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং তা নিয়ে কারখানার মালিকের সঙ্গে বিরোধ ছিল। অগ্নি সংযোগের ব্যাপারে কোন শ্রমিক না, বরং ঝুট ব্যবসায়ী জড়িত ছিল। যিনি সরকার দলের স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি।
মোট কথা শ্রমিক অসন্তোষের সুযোগ যে কেউ নিতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সাবোটাজ করছে মালিকরা নিজেরাই। অন্যদিকে, শ্রমিকরা স্বতঃস্ফুর্ত জাগরণের মধ্য দিয়ে যে ধরণের ঐক্য ও সংহতির পরিচয় দিয়েছে তাতে প্রলেতারীয় বৈপ্লবিক চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা যেভাবে দলবদ্ধভাবে বাস করতে শিখেছেন। বদমায়েসদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে শিখেছেন এবং সর্বোপরি মালিকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে ও সংগ্রাম করতে অভ্যস্থ হয়েছেন, তাতে তারা যে প্রগতি ও নারী মুক্তির পথ দেখাবেন, সে আস্থা আমাদের তৈরী হচ্ছে। শ্রমিক আন্দোলনে নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হবে বলেই আমার বিশ্বাস রয়েছে।